Pabitra Kundu's touching farewell letter to his late friend and colleague Al Musabbir Sadi Pommel...
পামেলকে শেষ চিঠি
তারিখ: ২১-০৫-২০১১
স্মৃতির ফ্রেমে আল মুসাব্বির সাদী (পামেল): ২০০৩ অস্ট্রেলিয়া সফরে
প্রিয় পামেল,
স্কয়ার হাসপাতালের ১৪০৭ নম্বর কেবিনের শুভ্র বিছানায় যন্ত্রণাকাতর মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেছিলে, তোমার অসম্ভব মনের জোরটা দিয়ে লড়াইটা চালিয়ে যাবে। কিছুতেই হার স্বীকার করবে না। তুমি কথা রাখতে পারলে না পামেল! মৃত্যুর কাছে শেষ পর্যন্ত হেরেই গেলে। যে ক্যানসার তোমার পাকস্থলীতে বাসা বেঁধেছিল অজ্ঞাতে, সেটাই তোমাকে শেষ করে দিয়ে গেল।
এমন তো নয়, বার্সেলোনার সঙ্গে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ‘যুদ্ধ’, ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে হ্যারল্ড লারউডের, কিংবা ইভান্ডার হলিফিল্ডের সঙ্গে মাইক টাইসনের লড়াই। এটা ক্যানসার, একেবারে অব্যর্থ ঘাতক। তুমি পারলে না। মাত্র অল্প কদিনের ‘প্রস্তুতি’তে তুমি লড়াইয়ের ইঞ্চি কয়েক জমিই বের করতে পারলে না। এই তো গত মার্চ মাসে তুমি জানতে পারলে, ক্যানসার তোমার সামনে এসে গেছে। পর পরই গেলে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে। সেখানে ‘কেমো’ দেওয়া হলো দুই দফা। ফিরে এলে ঢাকায়, স্কয়ার হাসপাতালে। কথা ছিল শরীরে একটু শক্তি সঞ্চয় করে আবার যাবে সিঙ্গাপুরে। শরীরটাই আর শক্ত হয়ে উঠতে পারল না।
তোমার সেই দীর্ঘ সুদর্শন শরীরটাকে আঘাতে আঘাতে শিউরে ওঠার মতো জর্জরিত করে দিয়েছিল ক্যানসার। তবু তোমার মনের জোর ছিল, হ্যাঁ, সংশয়ও অবশ্য ছিল, তুমি নিজেই যেমন বলেছিলে ‘যদি ঠিকমতো খেতে পারতাম...।’ তুমি ঠিকমতো খেতেই পারোনি! অথচ তোমার সঙ্গী হিসেবে কয়েকটি সফরে গিয়ে জানি, নানা রকম খাবারের মধ্যে নতুন আবিষ্কারের আনন্দে মেতে উঠতে তুমি।
সবকিছুতেই তোমার আনন্দ ছিল। আনন্দ খুঁজে নিতে জানতে। তবে চির-আনন্দের উৎস খুঁজে পেয়েছিলে খেলার মধ্যে। ফুটবল, ক্রিকেটে—বিশেষ করে ফুটবলে। তোমার কাছের বন্ধুরা যেমন বলে, বরিশাল মেডিকেল কলেজে প্রথম বর্ষের পাঠ ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসাও ছিল ওই খেলারই টানে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে নিয়েছ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। অন্য কোনো চাকরি জোগাড় করারও চেষ্টা করোনি। খেলার কাছে থাকতে পারবে বলে ক্রীড়া সাংবাদিক হয়েছ। দৈনিক ইনডিপেন্ডেন্ট-এ শুরু ১৯৯৫ সালে, সেখানে টানা ১০ বছর কাটিয়ে যোগ দিয়েছ ডেইলি স্টার-এ। তারপর হঠাৎই যুক্ত হয়েছ ফুটবল ফেডারেশনে। তোমার প্রিয় ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন বাফুফের সভাপতি হলেন, তোমার ফুটবল-প্রজ্ঞা দেখে তিনি ডাক দিলেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তুমি যোগ দিলে বাফুফের বৈতনিক সাধারণ সম্পাদক পদে। দেশের ফুটবলের অচলায়তন ভাঙতে সালাউদ্দিন চেয়েছিলেন একটা তরুণ চিন্তাশীল প্রজন্ম ফুটবলের প্রশাসনে আসুক। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গিয়েছিল। কিন্তু জীবনের কঠিন অঙ্কটাই তোমার মিলল না পামেল! না হলে কেন এই ৪৪ বছর বয়সে, খেলার মাঝমাঠে থাকতে কিংবা হাফটাইমে মৃত্যু তোমার শিয়রে এসে দাঁড়াবে?
তুমি সবাইকে আপন করে নিতে জানতে। সবার প্রিয় ছিলে তুমি। কতটা তুমি জানো না। কাল ভোরের আলো ফুটতেই চিকিৎসকেরা চিরদিনের মতো তোমার ছুটি ঘোষণা করে দিলেন, আর দুপুরে যখন আলিফ মেডিকেলের লাশবাহী গাড়িতে বরফের চাইয়ের মধ্যে কফিনে শুয়ে এলে মধুবাগে তোমার পৈতৃক বাড়ির সামনে, সেখানে অজস্র লোক তোমার মুখটা একবার দেখবে বলে কী ব্যাকুল হয়ে ছিল! সেখানে ছিল তোমার সহপাঠীরা, ছিল তোমার ক্রীড়া সাংবাদিক সতীর্থরা। তোমার জানাজা হলো মধুবাগ মসজিদের সামনে। লোকে লোকারণ্য!
আজ দুপুরে শেষবারের মতো তোমার জানাজা হবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। তারপর চলে যাবে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে, যেখানে নেবে শেষশয্যা। তার আগে তোমার ‘আইডল’ তোমার চিকিৎসক বড় ভাই আল মুতাফি সাদী (অ্যাঞ্জেল) আসবেন কানাডা থেকে। তাঁর সঙ্গে দেখা না করে তো তুমি শেষশয্যা নিতে পারো না!
তোমার প্রয়াত বাবা আবদুল কুদ্দুস সাদী ছিলেন লেখক, পুস্তক প্রকাশক। মা ছিলেন শিক্ষিকা। অন্তরটা তোমার আলোকিত হয়েছে অনেকটা সেই সূত্রেই। তুমি ছিলে আমার দেখা অন্যতম আলোকিত তরুণ। আর সেই তুমিই কিনা আজ এক অচেনা অন্ধকারে ঢুকে যাবে? তোমার দুই ছেলে নয় বছরের আরিয়ান আর সাড়ে তিন বছরের আরহান অবশ্য তোমাকে আলোর দিশারী হিসেবেই খুঁজে পাবে। তোমার চিকিৎসক স্ত্রী নাসরিন জাহান রত্না নিশ্চয়ই তোমার চেনানো রাস্তাটা তাদের দেখিয়ে দেবেন।
ওরা হয়তো তোমাকে সশরীরে পাবে না। তোমার কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি সঙ্গী হবে তাদের। প্রথম আলোয় লেখা তোমার কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থের অক্ষরে অনুভব করবে তোমায়। আর আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবে তোমার কিছু সঙ্গসুধা।
কিন্তু সবশেষে বলি, তুমি কথা রাখোনি। এই অবেলায় আমাদের ছেড়ে গেলে। পৃথিবীর সেরা চিকিৎসকও যদি বলতেন কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে তোমাকে সুস্থ করে তোলা যাবে, আমরা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার পেছনে ছুটতাম। তোমাকে যেতে দিতামই না!
তোমার নিত্য শুভার্থী
পবিত্র কুন্ডু
Source