অমর একুশ। মহান শহীদ দিবস। ১৯৫২ সালের এ দিনে দেশ মাতৃকার অকুতোভয় বীর তরুণেরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে দুর্জয় প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন। দুর্জয় চেতনাদীপ্ত সাহসী তরুণদের রক্তের মুল্যে বাংলাদেশ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়েছিল সেদিন। ১৯৫২ সালের সেই ২১ (বা ৮ ই ফাল্গুন) এর শিক্ষা ও চেতনায় উজ্জীবীত হয়ে আমরা ‘৬৬ এর ছয় দফা, ‘৬৯ এর গনঅভ্যুত্থান, ‘৭০ এর নির্বাচন, ’৭১ এর মুক্তি সমর এবং ’৯০ এর গনতণত্র আন্দোলনে বিজয় লাভ করেছি। আমাদের চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ২১ তাই প্রেরণার এক চির অমলিন আলোকবর্তিকাবাহক।
নতুন শতকে ২১ আমাদের ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের গণ্ডি পেরিয়ে পরিব্যপ্ত হয়েছে বিশ্বময়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মোড়কে ২১ বিশ্ব দরবারে কেবল আমাদের ভাবমূর্তিকেই উজ্জ্বল করেনি, বরং নিজস্ব মাতৃভাষার প্রতি প্রতিটি মানুষের সুগভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধের যে চেতনা রয়েছে, সে চেতনাকেও করেছে আরো প্রখর এবং শাণিত।
প্রতিবছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আমারা প্রভাতফেরি, সভা-সেমিনার, বই মেলা ইত্যাদির আয়োজন করে থাকি। অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে চলে আসা এই গতানুগতিক ব্যাপারগুলো একপাশে রাখার পর ২০০৮ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি প্রশ্ন আমি দেখতে পাই। সেটি হল বাংলা এবং ইংরেজি নিয়ে আমাদের মেরুকরণ অবস্থান। বাংলাদেশে আজকাল ব্যঙের ছাতার মত ইংরেজি মিডিয়ামের অনেক স্কুল-কলেজ হয়েছে, এবং সেখানে যারা লেখাপড়া করছেন, তাদের মধ্যে অনেকে আজকাল বাংলা ভাষাকে প্রায় ব্যবহার করেন না বললেই চলে। এমনকি অনেকে তাদের ঘরের কাজের ছেলেটির সাথেও ইংরেজি বলার চেষ্টা করেন। বাংলার প্রতি অবজ্ঞার ভাবও লক্ষ্যণীয় অনেকের মধ্যে। অন্যপক্ষে আছেন তারা, যারা সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলনের সিদ্ধান্তে ইংরেজিকে foreign language থেকে second language করতে নারাজ। দুই পক্ষেরই অবস্থান পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশ্বায়েনের এই যুগে টিকতে হলে আমাদের অর্থনীতি সবল করতে হবে, এবং আমারা বাংলাদেশিরা যদি আরেকটু ভালো ইংরেজি জানি, তাহলে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা আরো একধাপ অর্জন করা সম্ভব। প্রতিবেশি দেশ ভারত এবং শ্রীলংকা তার বড় প্রমাণ। ইংরেজিকে second language করার মত অবস্থা জনবল ও পরিবেশগত দিক থেকে আমাদের এই মুহুর্তে নেই, কিন্তু উদ্যোগ নিলে সময়ে সবই সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া ভাষা কখনো পড়াশোনার প্রতিবন্ধক হবে না। নাট্যকার মুনীর চৌধুরি মনে করতেন, ভাষা নয়, একটি দেশের বিরাজমান আর্থসামাজিক অবস্থা হতে পারে সেই দেশের শিক্ষার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। আমাদের দেশই প্রমাণ-সেশন জট, হরতাল...। আবার যারা বাংলাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন, তাদের মনে রাখা উচিত যে যুগ বিশ্বায়নের হতে পারে, কিন্তু বিশ্বায়নের গড্ডালিকা প্রবাহে আমাদের মুল, স্বাতণত্র, ও স্বকীয়তা হারানোর কোন সুযোগ নেই। সে জন্যই বাংলা শেখাটা প্রয়োজন। কেননা বাংলাদেশী হয়ে বাংলা যদি না জানি, তাহলে আমাদের মধ্যে এক ধরণের অপুর্ণতা রয়েই যাবে, যে অপূর্ণতা অন্য কোন ভাষা বা জ্ঞান-বিজ্ঞান পূরণ করতে পারবে না। প্রাবন্ধিক আবুল ফজল তার কোন এক প্রবন্ধে বলেছিলেন যে নাড়ির সম্পর্ক আছে যে ভাষার সাথে, সে ভাষা ভালো করে জানেন বলেই তিনি ভালো করে জানতে পেরেছিলেন তার দেশকে, দেশের মানুষকে, তার ঘরকে এবং তার প্রিয়াকে। এটি কিন্তু খুবই সত্যি ও খাঁটি কথা। আমার কাছে এবারের ২১ এর resolution তাই এই দু পক্ষের মধ্যে সমন্বয়, যা আমি বিশ্বাস করি খুবই জরুরী ও সময়ের দাবি।
পরিশেষে, ভাষার জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাদের যেন আল্লাহ জান্নাতবাসী করেন, এই কামনায়-
বাংলাদেশ শার্দুল
|